নভেম্বর ২৮, ২০২১
নাফিজা ঘুমাচ্ছে । গুটিসুটি হয়ে, ওপাশ ফিরে । ওর
এম বি বি এস শেষে প্র্যাকটিসের জন্য বিভিন্ন
বশিরের বড় মেয়েটার বিয়ের কথা চলছিল । ভেঙ্গে
#সমাপ্ত_গল্প
Bangla Golpo নাফিজা ঘুমাচ্ছে । গুটিসুটি হয়ে, ওপাশ ফিরে । ওর মুখটা দেখা যাচ্ছে না । আমার কেমন যেন অস্থির লাগছে । হয়তো ওর মুখটা দেখতে পারছি ...
#গল্পঃআমি_অথবা_সে
#গল্পঃআমি_অথবা_সে
2021-11-28
8
10
99
Bangla Golpo
নাফিজা ঘুমাচ্ছে । গুটিসুটি হয়ে, ওপাশ ফিরে । ওর
মুখটা দেখা যাচ্ছে না । আমার কেমন যেন অস্থির
লাগছে । হয়তো ওর মুখটা দেখতে পারছি না, তাই ।
আমি উঠে গিয়ে বিছানার ওপাশে দাঁড়াই । একটা
হাত মাথার নিচে দিয়ে আরেক হাত বুকের কাছে
নিয়ে শুয়ে আছে ও ।
কি নিষ্পাপ মুখটা ! আমি ওর
কপালে চুমু এঁকে দেই । নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোক ।
নাফিজা । আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ।
এ ঘরে কোনো ঘড়ি নেই । আমি ঘর থেকে বেরিয়ে
নিচের রুমে যাই । সাতটা বেজে সাইত্রিশ মিনিট ।
ডাইনিং টেবিলের পাশের বড় জানালাটা খুলে দেই
। ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখটা মার্ক করে
রাখতে হবে । আজ একটা বিশেষ দিন । এই দিনটা
ভুলে যাওয়া চলবে না ।
আচ্ছা মার্কার পেন কোনটা ব্যবহার করব ? কোন
রঙ ? কালো না লাল ?
সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না । মাথা ধরে যাচ্ছে ।
আজকাল এটা বেশী হচ্ছে । মার্কার পেন দুটো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ।
আচ্ছা...টস করলেই তো হয় ! এই সহজ ব্যাপারটা
মাথায় আসে নি কেন প্রথমে ! টস করলাম ।
কালো রঙ- এর মার্কার । হুমম...খারাপ
না । শোক দিবসের মত হবে । হা হা হা ।
ডাইনিং রুমে আসলাম আবার ।
ক্যালেন্ডারটাতে
২৭শে ফেব্রুয়ারি দিনটাতে মার্ক করতে গিয়ে
প্রচণ্ড অবাক হলাম । ঠিক ঐ দিনটাতেই লাল রঙ দিয়ে গোল মার্ক দেয়া ।
কে দিয়েছে এটা নাফিজা ? নাতো, ও কেন দিবে !
নাকি নাফিজা কিছু সন্দেহ করছে ? নাহ, মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না ।
হঠাৎই কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় হেসে উঠলাম আমি।
আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী । নাফিজা হয়তো
সেকারণেই মার্ক করে রেখেছে আজকের দিনটা ।
কিসব যা-তা ভাবছিলাম এতোক্ষণ !
আমি কালো মার্কারটা দিয়ে লাল দাগটার উপর
ঘুরিয়ে আঁকলাম ।
একটু বিদঘুটে দেখাচ্ছে দেখাক ।
মার্কার দুটো জায়গা মত ফেলে দিলেই চলবে । কেউ কোনোদিন খোঁজও পাবে না ।
নিচতলার বাথরুম থেকেই গোসল করে,ফ্রেশ হয়ে
বেরিয়ে দেখি সেই প্রিয় মুখ । নাফিজা জানালার
কাছের চেয়ারটাতে বসে আছে । শীতের সকাল ।
তবে আজ একটু রোদেলা । আবছা রোদের আলোয় নাফিজাকে আগের চেয়েও বেশী রূপবতী লাগছে ।
আনমনা হয়ে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ও
।
“রাতে ঘুম ভালো হয়েছিল ?”
নাফিজা ঝট করে ফিরে তাকালো । মুখে ছোট
একটা হাসি ফুটে উঠল ওর । চেহারা সহজ হয়ে এলো ।
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ।
“হ্যাঁ...তোমার ?”
“ভালো ।”
কফি-মেকার থেকে দু’কাপ কফি বানিয়ে নাফিজার
হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে ওর সামনের একটা
চেয়ারে বসলাম ।
বাচ্চা মেয়ের মত দু’হাত দিয়ে কাপ জড়িয়ে ধরে
অল্প অল্প করে তাতে চুমুক দিচ্ছে নাফিজা ।
আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই হয়তো
আমার দিকে মুখ ফেরালো ।
“কিছু হয়েছে ?”
আমি না-সূচক মাথা নাড়ি ।
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে নাফিজা ।”
ও মাথা নামিয়ে ফেলল । লাজুক হাসি ফুটে উঠেছে ওর মুখে । আমি একইরকম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি ।
সেই একই চোখ,একই ঠোঁট, একই রকম নাক, চোখের সামনে এসে পড়া এক গাছি চুল প্রতিদিনই দেখি ।
শুধু আজ না, প্রতিদিনই মুগ্ধ হই । শ্যাম বর্ণের এই
মেয়েটাকে এইটুকুতেই এতো সুন্দর লাগে কেন ? অসহ্য রকমের সুন্দর !
আমি কফির কাপটা নামিয়ে রাখি । নাফিজার
কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ও যা বুঝার বুঝে ফেলে ।
“না...না...এখন না” বলে মৃদু বাঁধা দিতে চাইলেও
আমি রাজি হই না । ওকে কোলে তুলে নিই । এই
সময়টা শুধুই আমাদের । আমি একজন সুখী মানুষ । বেশ সুখী । অসুখী হবার মত
কোনো ব্যাপার আমার সাথে ঘটে না ।
হয়তো সেকারণেই মাঝে মাঝে আমার ভয়ংকর কিছু একটা করার খুব ইচ্ছা হয় ।
ভয়ংকর...খুব বেশী ভয়ংকর ।
আজ সেরকমই ভয়ংকর কিছু একটা করার মত দিন ।
***
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমি নিজেকে আবিষ্কার
করেছিলাম আরও জনা পঞ্চাশেক ছেলেদের সাথে।
বড় একটা হলরুমে থাকতাম । একসাথে
খেতাম,ঘুমাতাম,পড়তাম,মারামারিও করতাম ।
জায়গাটাকে সবাই এতিমখানা বলে ।
আমি কি এতিম ছিলাম ?
যার বাবা-মা নেই তাকে এতিম বলে । আমার বাবা-মা ছিল ।
আমি ছিলাম তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান । আমার অবস্থা অনেকটা ‘থেকেও নেই’ এর
মত ।
হ্যাঁ, সেই অর্থে তাহলে আমি এতিমই ।
বাংলাদেশে এতিমখানা নিয়ে খুব খারাপ কিছু
ভাবা হয় । অনেকে ভাবে যে, এতিমখানার ভেতরে
কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলার বালাই নেই । ভুল ভাবে ।
আমাদের বেশ কড়াকড়ি নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে
হত । খাবার-দাবারও ভালো ছিল । প্রতি শুক্রবারে
মাংসের ব্যবস্থা ছিল । শুক্রবারের দিনটাতেই
মারামারিটা বেশী হত আমাদের মধ্যে । খাবার
নিয়ে কাড়াকাড়ি ।
সেসময় নেয়ামত আলী হুজুর আমাদের সবাইকেই
জালি বেত দিয়ে পেটাতেন । কেউ বেশী ঝামেলা
করলে তাকে আলাদা করে নিয়ে শাস্তি দেয়া হত ।
ভয়াবহ শাস্তি ।
আমাদের এতিমখানা জীবনের বিভীষিকা ছিল এই
লোকটা ।
সেখানে থাকাকালে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু
ছিল আব্দুল্লাহ । একদিন নেয়ামত হুজুরের শাস্তির
পাল্লায় পড়ে ও । ফলাফল, রাতে প্রচণ্ড জ্বর ।
একসময় রক্তবমি । রাত পেরিয়ে ভোর হবার আগে
আগেই মৃত্যু । সারাক্ষণ আমি ওর পাশেই ছিলাম ।
আব্দুল্লাহ মারা যাবার সময় ওর হাত আমার হাতে
ধরা ছিল । কি শান্ত,চুপচাপ সে মৃত্যু । আমি টেরই
পাই নি বলতে গেলে ।
পরদিন হুজুর বয়ান দেন, “আব্দুল্লাহর মৃত্যু
স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে । আল্লাহ-পাক ওর মৃত্যু
এভাবে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন । ওর সেটাই
হয়েছে । তা নিয়ে আমাদের কোনো দুঃখ করা উচিত নয় ।
মৃত্যু নিয়ে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে
এরশাদ করেছেন...”
আমি সেদিন চুপ করে ছিলাম । অন্যান্য দিনের মতই ।
এতিমখানায় আলিম পাস করা পর্যন্ত রাখা হয় ।
আমি আলিম পরীক্ষার ফলাফল দেয়া পর্যন্ত সেই
সেখানেই ছিলাম । এতিমখানাতে থাকার শেষ দিন
আমি হুজুরের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা পাই ।
আর চলে আসার আগে হুজুরের অতি প্রিয় কাপড়
ইস্ত্রির মেশিনটার তার আর প্লাগের লাইন ওলট-
পালট করে দিয়ে আসি ।
আমি এতিমখানা থেকে চলে আসার দিনই নেয়ামত আলী হুজুরের মৃত্যু হয় ।
আমি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলাম ।
পজিশন শেষের দিকে ছিল । তারপরও ঢাকা
মেডিকেল তো !
সবার সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড়,গাড় ি,বাড়ি দেখে আমার খুব লোভ লাগত ।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি একদিন বড়লোক হব ।
বিশাল বড়লোক । মেডিকেলে পড়ার সময়েই আমি নেয়ামত আলী
হুজুরকে খুন করার ঘটনাটা নিখুঁতভাবে লিখে চরিত্র- নাম পালটে ছদ্মনামে পাঠিয়ে দেই একটা দৈনিক পত্রিকায় । ওরা সেটা ছাপায় । লেখাটা কেমন করে যেন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় । আমার ছদ্মনাম ছিল ‘খুনে লেখক’। এই নামটা তখন রটে যায় ভার্সিটির অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মুখে। আমার শুনতে বেশ ভালোই লাগত ।
তবে, আমি কখনও আমার পরিচয় ফাঁস করিনি ।
এম বি বি এস শেষে প্র্যাকটিসের জন্য বিভিন্ন
হাসপাতালে যাওয়া লাগত । আমার পুরনো ইচ্ছাটা
মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইত । ভায়োলেন্স । আই লাভ ভায়োলেন্স ! কিন্তু আমি কিনা শেষমেশ হলাম চাইল্ড স্পেশালিষ্ট ।
ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চাদে র সর্দি,কাশি,পেট ব্যথার ডাক্তার ! বছর দুই এর মাথায় আমি ডাক্তারী থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নেই ।
সাত বছর ধরে করা টিউশনির সব টাকা,পার্ট টাইম টিচার ছিলাম সেটার টাকা আর ডাক্তার হিসেবে দু’বছরে আয় করা জমানো সব টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম ! অনেক টাকা ! আমি সব টাকা দিয়ে একটা ঔষধের দোকান খুলে বসি ।
অখণ্ড অবসর পুরনো লেখালিখির ইচ্ছাও জেগে উঠল ।
কিন্তু খাতা,কলম নিয়ে বসে একটা লাইনও লিখতে পারলাম না ।
আমি খুনে লেখক । খুন ছাড়া আমার লেখা সম্ভব না ।
সেদিন রাতেই আমি বেরিয়ে পড়ি । অনেক হাঁটতে
হাঁটতে কাকরাইলের মোড়ের কাছে একটা বন্ধ হয়ে
যাওয়া রেস্টুরেন্টের সামনে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট
একটা বিড়ালছানা পাই । বিড়ালটা সাদা রঙ এর ।
তবে চোখের পাশে আর পিঠে কালো রঙের ফুটকি
আছে ।
বেশ সুন্দর ! রাস্তার পাশে অর্ধেকটা থান ইট পড়ে ছিল ।
আমি সেটা তুলে নেই সন্তর্পণে । সম্পূর্ণ জোর না দিয়ে খানিকটা আস্তে বিড়ালটার মাথায় ইটটা দিয়ে আঘাত করলাম । বিড়ালটা ভয় পেয়ে,ব্যথায় অদ্ভুত স্বরে চেঁচিয়ে উঠে পালাতে চাইলো । সেই মুহূর্তে আমি ওটার একটা পা সম্পূর্ণ পিষে দিলাম ।
বিড়ালটার আর্ত-চিৎকার শুনতে বেশ ভালো লাগছে ।
ধীরে সুস্থে আমি বিড়ালটাকে মারতে থাকি
একেবারে থ্যাতলা করে দেই ।
আমি ফিরে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ঘটনাটা
গল্পের আকারে লিখে পাঠিয়ে দিলাম সেই
পত্রিকার সম্পাদকের ঠিকানায় ।
গল্পের নাম“আর্তনাদ” ।
সাত বছর পর আমার এই লেখা আবারো তুমুল জনপ্রিয় হল । আমি খুশিতে ফেটে পড়লাম । কিন্তু পরিচয় ফাঁস করিনি ।
আমি এরকম প্রায় প্রতিরাতেই একটা একটা করে খুন করতাম,কাউকে বিপদে ফেলে তারপর সেই
মানুষটাকে লক্ষ্য করতাম ।
তারপর সেই ঘটনাগুলোরপুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা লিখে দিতাম । দিন দিন আমার লেখা জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে লাগল ।
আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না । তবে এরকম কোন
একটা ব্যাপার আমার মধ্যে খুব বেশী পরিমাণে ছিল ।
মাত্র দুই বছরের মধ্যেই আমার দোকান থেকে প্রচুর পরিমাণে লাভ আসলো ।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি একটা ফার্ম খুলে বসলাম ।
আমাকে যে বড়লোক হতে হবে !
আমি লেখা পাঠানোর সময় খুব সাবধান থাকতাম।
প্রাপকের জায়গায় কিছু লিখতাম না । হাতের লেখা স্পষ্টভাবে যাতে বোঝা না যায়, তাই ইচ্ছা করে ছোট,বড় করে লিখতাম । পত্রিকাওয়ালারা আমাকে সম্মানীসূচক টাকা দিতে চাইলেও আমি নেই নি কখনো । রাস্তায় চলতে,ফিরতে গিয়ে নিজের লেখার প্রশংসা যখন শুনতাম, খুশিতে মন ভরে যেত ।
কেমন যেন এক অদ্ভুত আত্মতৃপ্তির অনুভূতি ।
নাফিজার সাথে দেখা হয় এরকমই এক সময়ে । আমি কখনই রোমান্টিক কিছু ছিলাম না । ভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক মেয়েই আমার সাথে মিশতে চেয়েছে, আমিই তাদের সবসময় এড়িয়ে গিয়েছি ।
ওসব মেয়েরা আমার সঙ্গ চাইতো । সঙ্গটা সৎ ভাবে ছিল না ।
বোকা মেয়ের দল ! কিন্তু...কিন্তু নাফিজা অন্যরকম ছিল । ছিল মানে এখনো আছে ।
ওর মধ্যে কিছু একটা আছে যেটা সবার থেকে আলাদা ।
সেটা হল, এই মেয়েটার ভালোবাসার ক্ষমতা । এই
মেয়েটা ভালোবাসতে জানে । ও আমাকে ভালোবাসে ।
অনেক অনেক বেশী ভালোবাসে । আমিও নাফিজাকে ভালোবেসেছিলাম । এখনও বাসি । নাফিজার সাথে পরিচয়ের পর বিয়ে হয়ে
যেতেও খুব বেশী সময় লাগেনি । মধ্যবিত্ত ঘরের
মেয়ে ছিল । আমি ততদিনে বেশ বিত্তবান । ওর
বাবা-মাও বিয়েতে মত না দেয়ার কোনো কারণ
পান নি ।
লেখা নিয়ে আশেপাশের মানুষজনের কাছ থেকে
নানারকম মন্তব্য শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, বই
বার করব । এ বুক, ফুল অফ কমপ্লিট ভায়োলেন্স ! এমন গল্প, এমন ভয়ের অনুভূতি আগে কেউ কখনো পড়ে নি ।
আমার ফার্মের অবস্থা তখন বেশ ভালো ।
মাত্রাতিরিক্ত ভালো । উন্নতির দিকে এগিয়ে
যাচ্ছিলাম দ্রুত ।
প্রায় চার হাজার কর্মী রয়েছে আমার এখানে । আমার পরবর্তী গল্পের টার্গেট হল এই কর্মীদের মধ্যে প্রধান দুজন (সুমন এবং বশির) ।
আমি খুব সূক্ষ্ম চাল ফেললাম । প্রথমে এই দুজনের মধ্যে একটা ঝগড়া লাগানোর ব্যবস্থা করি রফিককে দিয়ে । রফিকও আমার প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী ।
বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী । সেও আমার পরিকল্পনার একটা অংশ । ঝগড়া-কলহ থেকে একসময়
কোন্দল,আন্দোলন,ধর্মঘট । মোক্ষম সময় ।
আমি রফিককে ডেকে এনে পুরো জায়গাটায় আগুন লাগিয়ে দেয়ার জন্য বলি ।
রফিক অবাক হলেও দ্বিমত করে না ।
পুরো কারখানাটা যখন দাউ দাউ করে আগুনে
জ্বলছিল আমি তড়িঘড়ি করে পুলিশ ফোন দিয়ে
জানাই । তারপর ফায়ার সার্ভিসে ফোন দেই ।
আমার কাঁচের দেয়ালের রুমটা থেকে আগুনের শিখা
দেখা যাচ্ছিল বেশ স্পষ্টভাবে । আমি ড্রয়ার থেকে
নতুন কেনা রিভলভারটা বের করে নিলাম । কেনার
পর থেকেই নিয়মিত প্র্যাকটিস করে হাত পাকিয়ে
ফেলেছি । গুলির চেম্বারটা চেক করে, ঠিকমত
পরিষ্কার করে নিয়ে হাতের কাছে রাখলাম ।
রফিক একটু পরেই আসবে ওর পাওনা টাকা নিতে।
মনে মনে হাসলাম আমি ।
আমি রফিককে গুলি করি ঠিক কপালের মাঝ বরাবর ।
টু শব্দ করার আগেই ওকে ধরে নিয়ে উপর থেকে
জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দেই । প্রমাণ খতম ।
রিভলভারটা আবার চেক করে নিলাম । ততক্ষণে এর মাথায় সাইলেন্সর শোভা পাচ্ছে ।
বীমা কোম্পানি তদন্ত চালিয়ে শেষ পর্যন্ত কিছুই
না পেয়ে আমাকে তাদের সন্দেহের তালিকা
থেকে অব্যাহতি দিয়ে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিল।
আর এর মাঝের ক’দিন আমি ঘুরে বেড়ালাম সেই
দুজনের বাসায় । (সুজন আর বশির) ।
দুজনকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে । আমিই অভিযোগ এনেছি তাদের বিরুদ্ধে ।
বশিরের বড় মেয়েটার বিয়ের কথা চলছিল । ভেঙ্গে
গেছে । সুমনের বড় ছেলেটা বাড়ি ছেড়ে গেছে
দু’তিন দিন আগে । সংসার কিভাবে চলবে তারা
সেটা জানে না । সব ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে
বসে এসেছে ।
এই যে,আমিই তাদের পরিবারের ভাঙ্গনের জন্য মূল দায়ী । একথাটা এখন তারা জানে না, তাই ধরে নিয়েছে নিয়তি, তারা শান্ত রয়েছে ।
কিন্তু যখন সব আসল কথা জানবে, তখন তারা নিয়তির হাতে সবকিছু দিয়ে বসে থাকতে পারবে না ।
তারা ছুটে আসবে আমাকে মেরে ফেলতে,প্রতিশোধ নিতে ।
রাতে ডিনারের ব্যবস্থা করলাম আমি নিজেই । প্রায়ই করি । আর কফির ব্যবস্থা করে নাফিজা । আজ কফিও আমি বানালাম । এই কফি দিয়েই হবে সব কাজ । সাদা শাড়ি পরা অবস্থায় নাফিজাকে আজকে সত্যিই অপ্সরীর মত লাগছে । কি সুন্দর, মায়াময় এই মুখটা ! কফি নিয়ে রুমে ঢোকার পর নাফিজাই দরজা লাগিয়ে দিল । ওর মুখে দুষ্ট হাসি । এটাই ওর শেষ হাসি হবে ।
গল্পে ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলতে হবে পুরো ব্যাপারটা।
আমি পূর্ণ মনোযোগে কাজ করতে লাগলাম । কফিতে অল্প করে পটাসিয়াম সায়ানাইড দেয়া আছে । ধীরে ধীরে কাজ করবে । আমার সেটাই চাই । কষ্ট দেয়ার পুরো প্রসেসটা সম্পূর্ণ তুলে ধরা যাবে তাহলে ।
কফির কাপটা রেখে আমি মৃদু হেসে নাফিজার হাতে হাত রাখতেই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ও আমার হাতে ইনজেকশন দিয়ে কিছু একটা পুশ করে দিল। প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠি আমি ।
“এটা কি নাফিজা !” নাফিজা হাসে । “তুমি কখনও ‘খুনে লেখক’ নামের লেখকের লেখা পড়েছ ?” আমি হা হয়ে যাই ।
ও একটু আগে আমার শরীরে কি দিয়েছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই আমার । আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে যাওয়া শুরু করে । হাঁটু মুচড়ে বসে যাই আমি । “জানো, উনি না খুব সুন্দরভাবে মানুষের শারীরিক কষ্টের বর্ণনা লিখতে পারেন । লেখাগুলো পড়লে কেমন যেন মাদকতা ভর করে । খুন করতে ইচ্ছা করে ।
প্রচণ্ড কষ্টে মরে যাওয়ার সময় মানুষের মুখ কেমন হয়, সেটা জানতে ইচ্ছা করে । অ্যাই...তুমি কি মরে যাচ্ছ ? প্লিজ এখনই মরে যেওনা । তোমার মুখটা আর কিছুক্ষণ দেখি । খুব কষ্ট হচ্ছে, না ?
” নাফিজা আগেও বোকা ছিল, এখনও তাই রয়েছে । ও প্রচণ্ড তীব্র কোনো বিষ আমার শরীরে দিয়ে দিয়েছে । আর বেশীক্ষণ নেই । আমি বুঝতে পারছি, আর বেশীক্ষণ টিকব না আমি । আমার অস্ত্র আজ আমার উপরই প্রয়োগ করা হয়েছে । আমি ঘাড় ঘুরিয়ে নাফিজার মুখটা দেখার চেষ্টা করি । ইসস, এতো মায়া কেন মুখটায় ? ওর চোখের বিষণ্ণতাই কি এই মায়া ফেলেছে মুখে ? চকিতে আমার একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল । আমি হা করে দম নিতে থাকলাম । প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে । নাফিজা একমনে কথা বলে যাচ্ছে । কিছু বুঝতে পারছি, কিছু পারছি না । তবে আমাকে শেষ কাজটা করে যেতেই হবে । গায়ে যতটুকু শক্তি ছিল তার সাথে মনের পুরোটা জোর দিয়ে আমি সজোরে লাথি হাঁকাই টেবিলটার পায়ায় । কফির কাপটা উলটে পড়ে গেল মেঝেতে । আমি চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ি । কাজ শেষ । আর মাত্র কিছুক্ষণ । নাফিজা আমাকে দেখুক,আমিও ওকে দেখি । শেষবারের মত । ওর চোখেমুখে কিশোরী মেয়ের মত আনন্দ ফুটে উঠেছে । আর খানিকটা উন্মাদনা । আমি কষ্ট সহ্য করে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকি । আমার শেষ গল্পের শেষটা যে এমন হবে, সেটা আমি কখনও ভাবিনি ।
কি অদ্ভুত রকমের এই বিশ্বাস তাদের ! মরুক বোকা গাধার দল । এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে লেখা বই আমি প্রকাশ করি মাস ছয়েক পর । এটা তখনকার সময়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে বেস্ট সেলার হয়ে যায় । সবখানে শুধু একটাই নাম । ‘খুনে লেখক’ । এই কটা দিন নাফিজাকে আমি একদমই সঙ্গ দিতে পারছিলাম না । তবে ও আমার ব্যস্ততা বুঝতে পারছিল । ও ঠিক মানিয়ে নিয়েছিল । মেয়েটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়েই যাচ্ছিল দিন দিন । আমার প্রথম বই প্রকাশ হবার পর বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যায় বেশ দ্রুত । সারা শহরে হঠাৎ করেই খুন, ডাকাতি, মারামারি বেড়ে গেল । একেবারেই সহজ-সরল মানুষজনও রাতের আঁধারে হয়ে উঠতে শুরু করল ভয়ংকর । পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখা হল বেশ । সেসব মানুষদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর জানা গেল, তারা এই আমার লেখা পড়েই হঠাৎ করে বর্বর দৃশ্যের অদ্ভুত সৌন্দর্যটা দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠেছে । মৃদু হাসি আমি । যাক, আমি কিছুটা হলেও সফল । প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই অপরাধ প্রবণতা থাকে । তা নাহলে অপরাধ সমর্থন করে এতো এতো গল্প লেখা হত না । মুভি বানানো হত না । অথবা আমার মত লেখক এতো বিখ্যাত হতে পারত না । আমি বর্বরতার দৃশ্যগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখতে পেরেছি বলেই মানুষজন আমার লেখা এতো বেশী পছন্দ করে । অনুকরণ করে । আমার লেখা নিষিদ্ধ করে দেয় সরকার । তাতে বরং আরও ভালোই হল । সাধারণ লেখকের চেয়ে নিষিদ্ধ লেখকের প্রতি সবার আকর্ষণ সবসময়েই বেশী থাকে । এর কিছুদিনের মধ্যেই আবার খবর পাওয়া গেল, আমার গল্পের কাহিনীর সাথে কারখানা পুড়িয়ে ফেলার ঘটনার মিল পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ । কিন্তু কোনো প্রমাণের অভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না । আর এসব খবরই পেলাম দৈনিক পত্রিকাগুলোতে । এই বোকা সাংবাদিকরা কি জানে না যে, তারা যেসব তথ্য প্রকাশ করে সেগুলো অপরাধীদের জন্য কতটা উপকারী ? আমি কিছুদিন গা ঢাকা দেওয়ার কথা ভাবলাম । অফিসে ছুটি ঘোষণা করে আমি আর নাফিজা ঘুরে বেড়াতে লাগলাম । ওকে এতোগুলো দিন একদম সময় দেয়া হয়নি । আমরা কক্সবাজার,সেইন্ট মার্টিন আইল্যান্ড,মংলা বীচ,পতেঙ্গা বীচ সব জায়গায় ঘুরে বেড়াই । বিদেশে কোথাও যেতে চাইনি, কারণ গোয়েন্দারা নিশ্চয়ই এয়ারপর্টের দিকে লক্ষ্য রাখছে । সন্দেহ করতে পারে, যে, আমি দেশ থেকে পালাতে চাচ্ছি কি না । আমি সন্দেহ বাড়াতে চাইলাম না আর । নাফিজার সাথে একান্তে সময় কাটাতে কাটাতেই আমি নতুন গল্পের প্লট খুঁজতে লাগলাম । নাফিজাকে কক্ষনো আমার লেখক পরিচয় দেই নি ।একদিন সী-হোটেলের নিজস্ব সমুদ্রের জায়গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে খেয়াল করলাম নাফিজা ডুবে যাচ্ছে । ও সাঁতার জানে না । আমার হঠাৎ করেই ইচ্ছে হচ্ছিল ডুবন্ত মানুষের মৃত্যুর সময় দেখতে কেমন লাগে তা দেখতে । কিন্তু নাফিজা আমাকে সে সুযোগ না দিয়ে আমার হাত জড়িয়ে ধরে উঠে চলে আসল । নাফিজা বেঁচে যায় সেদিন । কিন্তু আমার মাথায় আটকে থাকে ব্যাপারটা । আমার পরবর্তী গল্পের জন্য উৎসর্গিত হবে আমার স্ত্রী, নাফিজা । বহুদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা করে এইদিনের কথা ভেবেছি আমি । আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী । আর নাফিজার মৃত্যুদিন; এখনও হয়নি...তবে হবে ।
#সমাপ্ত_গল্প
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)